সয়াবিনের সাতকাহন
ড. এম এ মান্নান
সয়াবিন প্রকৃতির এক অপূর্ব উপহার বা আশ্চর্য ফসল। কম গ্লাইসেমিক সূচক, কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং কোলেস্টেরল মুক্ত এবং পুষ্টিগত সুবিধার কারণে এটাকে “গোল্ডেন বিন” ও বলা হয়। এটি একটি বহুমুখী এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসল যা বাংলাদেশের মানুষের মাঝে এর গুরুত্ব বাড়ছে। এটি ডাল বা শিমজাতীয় উদ্ভিদ বিধায় এর শিকড়ে রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়া বাতাসের নাইট্রোজেন সংযোজন করে মাটিতে উদ্ভিদের মুখ্য পুষ্টি উপাদান নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
ব্যবহার ও পুষ্টি
উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারের (গরুর দুধ এবং মাংস, মাছ এবং হাঁস-মুরগি) মতোই সয়াবিনের অনন্য পুষ্টি গুণ রয়েছে এবং এটি মানুষের দৈনন্দিন প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। এর প্রোটিনের ৮৫% জুড়ে রয়েছে বিটা-কনগ্লাইসিনিন এবং গ্লাইসিনিন। সয়াবিনের দানায় বিদ্যমান কোলিন নামক রাসায়নিক পদার্থ মেধাশক্তি বাড়ায়। সয়াবিনে কার্বোহাইড্রেট কম থাকায় ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য ভালো। সয়াবিনে মানবদেহের প্রয়োজনীয় প্রায় সব এমাইনো এসিড আছে। সব মাছ, মাংস, ডালসহ সব খাদ্যের চেয়ে আমিষ অনেক বেশি থাকে। ক্যালসিয়ামের পরিমাণ সব ডালের চেয়ে ২-৭ গুণ বেশি আছে। প্রতি ১০০ গ্রাম সয়াবিনে থাকে আমিষ ৪০ গ্রাম, তেল ২০ গ্রাম, শ্বেতসার ১৩ গ্রাম, আঁশ ৪ গ্রাম, খনিজলবণ ৫ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২৫০ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৭০০ মিলিগ্রাম, আয়রন ৭ মিলিগ্রাম ও পটাশিয়াম ১৫৩৩ মিলিগ্রাম। প্রতিদিন ৫০-৬০ গ্রাম সয়াবিনজাত খাদ্য খেলে আমিষের চাহিদা পূরণ হয়। সয়াবিনে অসম্পৃক্ত ফ্যাট এসিড থাকায় হৃদরোগীদের জন্য উপকারী। এটি মানুষ এবং হাঁস-মুরগির জন্য কম খরচে প্রোটিন এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের একটি ভালো উৎস হিসেবে কাজ করায় উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের জন্য সয়াবিন একটি অন্যতম মূল্যবান ফসল। অন্য দিকে এটি ফসফরাস এবং ক্যালসিয়াম এ ভরপুর। এ ছাড়াও এর তেলে ভিটামিন-এ, ডি, লেসিথিন এবং মূল্যবান ফ্যাটি এসিড রয়েছে।
জমি স্বল্পতার জন্য ও সয়াবিনে মাত্র ২০-২২% তেল থাকায় এখনো প্রচলিত পদ্ধতিতে সয়াবিনের বীজ থেকে বাংলাদেশে তেল উৎপাদন সম্ভব হয়নি। তাই দেশে উৎপাদিত সয়াবিনের বেশির ভাগই প্রধানত পশু ও হাঁস-মুরগির খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় এবং বাজারের সব সয়াবিন তেলই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। অধিকাংশ মানুষের ধারণা সয়াবিন থেকে শুধু তেল উৎপাদন করা হয়। কিন্তু বাস্তবে সয়াবিনের অন্যান্য শস্যের মতো উপযোগিতা আছে। তেলের পাশাপাশি সয়াবিন থেকে টফু, পরোটা, সয়া জিলাপি, মসলাযুক্ত সয়াবাদাম বা নাট, সয়াপেঁয়াজু, সিঙ্গারা, সয়াচটপটি, সয়াময়দা, সয়াশিশুখাদ্য, সয়াডাল, সয়াহালুয়া, সয়াখিঁচুরি, সয়াপাতরা, সয়াভর্তা, সয়াবিন মিশ্রিত মিষ্টি কুমড়ার তরকারি, সয়াবিন মিশ্রিত আলুর তরকারি, সয়াবিন মিশ্রিত শাক, সয়াদুধ, সয়াদই, সয়াভাঁপা পিঠাসহ ৩৬ রকমের খাদ্য প্রস্তুত করা যায়। সয়ার আটা থেকে নাগেট বা বড়ি তৈরি করা হয়। এটি খেতে অনেকটা মাংসের মতো। মাংসে যে পরিমাণ পুষ্টি থাকে, সেই পরিমাণে পুষ্টি সয়াবড়িতেও পাওয়া যায়। তাই একে সবজিভোজীদের মাংসও বলা হয়। এটি বেশ মজাদার খাবার। সয়া নাগেট মাংসের মতো রান্না করা হয়। এ ছাড়া নিরামিষ, সবজি ও তরকারি যেভাবে রান্না করা হয়, সেভাবেও রান্না করা যায়। সয়াবিনের স্বাস্থ্য উপকারিতার মধ্যে রয়েছে সয়াবিনে চর্বি কম এবং এতে কোলেস্টেরল নেই সয়াবিন ফাইবারের একটি চমৎকার উৎস এটি ভিটামিন বি১২ এর একটি ভাল উৎস হিসেবেও বিবেচিত হয় সয়াবিন অ্যামিনো অ্যাসিড ধারণকারী প্রোটিন খাদ্য যা মানুষের শরীরের জন্য অপরিহার্য সয়াবিন সেবনে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়, হৃদরোগ এবং অস্টিওপরোসিস থেকেও রক্ষা করে।
সয়াবিন গাছ বাতাস থেকে প্রতি হেক্টর জমিতে ৭৫-১২০ পাউন্ড নাইট্রোজেন জমা করে বলে ইউরিয়া সার লাগে না এবং পরের ফসলে ইউরিয়া সার কম লাগে। সয়াবিনের পর গম চাষ করলে ৩৬% ফলন বেশি হয়। সয়াবিন সারা বছর চাষ করা যায় অর্থাৎ রবি ও খরিফ মৌসুমে চাষ করা যায়। সয়াবিন চাষে সার, সেচ, কীটনাশক, পরিচর্যা কম লাগে বলে উৎপাদন খরচ খুব কম। সয়াবিনের পাতা ফসল পাকার সময় ঝরে পড়ে ফলে মাটিতে জৈব পদার্থ যোগ করে বিধায় মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। রোপা আমন ধান কাটার পর বিনা চাষে বিনা খরচে সয়াবিন চাষ করা যায়। বিভিন্ন ফসলের সাথে আন্তঃফসল ও সাথী ফসল হিসেবে চাষ করা যায়। এজন্য অতিরিক্ত জমির প্রয়োজন হয় না।
চাষপদ্ধতি
সয়াবিন চাষ করা খুব সহজ। দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ, এঁটেল দো-আঁশ মাটি সয়াবিন চাষের জন্য ভালো। ৪-৫টি চাষ দিয়ে জমি তৈরি করতে হয়। রবি মৌসুমে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে এবং খরিফ মৌসুমে জুলাই-আগস্ট মাসে বীজ বপন করতে হয়। সারি থেকে সারি ১ ফুট এবং বীজ থেকে বীজ ৫-১০সেমি. দূরে দূরে বপন করলে ফলন বেশি হয়। তবে ছিটিয়েও বীজ বপন করা যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সয়াবিনের উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে এবং কৃষকপর্যায়ে চাষ হচ্ছে । প্রতি হেক্টরে গোবর ২০ টন, ইউরিয়া ৪০ কেজি, টিএসপি ১৫০ কেজি ও এমওপি ১০০ কেজি দিয়ে চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে জীবাণু সার প্রয়োগ করলে ইউরিয়া সার লাগে না। আগাছা হলে দমন করতে হবে। খরা হলে সেচ দিতে হবে। পোকামাকড়ের মধ্যে বিছাপোকা দ্বারা সয়াবিন গাছ আক্রান্ত হলে আক্রমণের প্রথম অবস্থায় পোকাসহ পাতাটি তুলে পায়ে মাড়িয়ে বা গর্তে চাপা দিয়ে মারতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে কার্বারিল গ্রুপের কীটনাশক যেমন- সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক যেমন-কট ১০ ইসি ১ মিলি বা সিমবুশ ১০ ইসি ০.৫ মিলি./লি. পানিতে মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে। ছাই ছিটিয়ে বা নগস স্প্রে করেও দমন করা যায়। কা-ের মাছি ও পাতা মোড়ানো পোকা দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। সাধারণত রোগজীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয় না। ৯০ থেকে ১২০ দিনে সয়াবিন পরিপক্ব হয়। প্রতি হেক্টরে প্রায় ১৫০০ থেকে ২০০০ কেজি ফলন হয়। সয়াবিনের বীজ সংরক্ষণের জন্য বীজের আর্দ্রতা ১০-১২% হতে হবে। পাত্রের মুখ ভালো করে বন্ধ রাখতে হবে। বীজের পাত্র ঠা-া স্থানে রাখতে হবে।
সয়াবিন নিয়ে গবেষণা
বাংলাদেশে সয়াবিনে প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও এ নিয়ে গবেষণা বেশি হয়নি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৯৯০ সালে সোহাগ (পিবি-২), ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সয়াবিন-৪ (জি-২), ২০০৬ সালে বারি সয়াবিন-৫, ২০০৯ সালে বারি-সয়াবিন-৬ এবং ২০২০ সালে বারি সয়াবিন-৭ নামে সয়াবিনের জাত উদ্ভাবন করে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত সয়াবিনের ৭টি (বিনা সয়াবিন-১, বিনা সয়াবিন-২, বিনা সয়াবিন-৩, বিনা সয়াবিন-৪, বিনা সয়াবিন-৫, বিনা সয়াবিন-৬, বিনা সয়াবিন-৭) জাত উদ্ভাবন করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগ ২০০৭ সালে তাইওয়ান এর এশিয়ান ভেজিটেবল রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে দুই শতাধিক সয়াবিনের জেনেটিক লাইন সংগ্রহ করে সয়াবিন নিয়ে গবেষণা শুরু করে । বর্তমানে এ বিভাগ সয়াবিন নিয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে গবেষণা করে যাচ্ছে । এ পর্যন্ত এ বিভাগ বিইউ সয়াবিন-১, বিইউ সয়াবিন-২, বিইউ সয়াবিন-৩, বিইউ সয়াবিন-৪ নামে ৪টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। যার মধ্যে বিইউ সয়াবিন-১ মাত্র ৬৫ থেকে ৭০ দিনে ফসল কাটা যায় এবং বিইউ সয়াবিন-৩ লবণ সহনশীল যা উপকূলীয় লবণাক্ত জমিতে চাষ করার জন্য উপযোগী। এ বিভাগ খরা ও জলাবদ্ধতাসহনশীল সয়াবিনের জাত উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বালাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ২৮.৬০ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে প্রায় ১০.৫৬ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততা আক্রান্ত। এই লবণাক্ত জমিতে লবণ সহনশীল সয়াবিন এবং বাংলাদেশের চরাঞ্চলে উচ্চফলনশীল সয়াবিনের চাষ করলে আমাদের দেশের পোল্ট্রি ও মাছের খাবারের জন্য সয়াবিনের চাহিদার অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব হবে।
প্রায় ৫০০০ বছর আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর প্রথম চাষ শুরু হয়। যখন চীনারা এর পুষ্টিকর মূল্যের জন্য একে ‘হলুদ গহনা’ এবং ‘মহান ধন’ হিসেবে উল্লেখ করেছিল। ১৮৯৪-৯৫ সালে কোরিয়ার উপর চীনা-জাপানি যুদ্ধ এবং চীনের বিপর্যস্ত পরাজয়ের পর ফসলটি জাপান এবং এশিয়ার অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ট্রেডিং ইকোনমিক্স অনুসারে, বতমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা এবং প্যারাগুয়ে সয়াবিনের প্রধান উৎপাদক। রপ্তানিকারক হচ্ছে চীন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মেক্সিকো এবং জাপান প্রধান আমদানিকারক। বিশ্বব্যাপী তেলজাতীয় ফসলের ৫০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে সয়াবিন।
বাংলাদেশে সয়াবিন চাষের সূচনা হয়েছিল ১৯৪২ সালে যদিও ১৯৬০-৬১ সাল পর্যন্ত এটির জনপ্রিয়তা বাড়ানো বা কোন গবেষণা করা হয়নি। ১৯৬১ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)-র ডাল এবং তেলবীজ বিভাগ খরিফ-২ মৌসুমে পতিত জমিতে আবাদের লক্ষ্যে সয়াবিনের দুটি জাত (পলিকান এবং বর্ণালী) বাছাই করেছিল। পরবর্তীতে হলুদ মোজাইক ভাইরাস এর প্রতি সংবেদনশীল হওয়ায় জাত দুটির উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৭২-১৯৭৩ সালে মেনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটি (এমসিসি) পুণরায় বাংলাদেশে সয়াবিন চাষ শুরু করে। ১৯৮২ সালে লক্ষ¥ীপুর জেলার রামগতি উপজেলায় মাত্র ১ হেক্টর জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে সয়াবিনের চাষ করা হয়। এরপর ১৯৯২ সালে এমসিসি ও ডর্প নামক দুটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সয়াবিন চাষে কৃষকদেরকে ব্যাপক উদ্বুদ্ধ করে। তখন থেকেই ধীরে ধীরে অন্য রবি ফসলের সাথে সয়াবিনের আবাদ বৃদ্ধি পেতে থাকে। বতমানে বাংলাদেশে ৬২,৮৭০ হেক্টর আবাদি জমি থেকে বছরে মোট ৯৬,৯২১ টন সয়াবিন উৎপাদিত হয়, যার প্রায় ৭০ ভাগ লক্ষ¥ীপুর জেলায় উৎপাদিত হচ্ছে যদিও দেশে ডেইরি ও পোল্ট্রি সেক্টরে চাহিদা মেটাতে বছরে প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টন সয়াবিন প্রয়োজন। কয়েক বছর আগে উপেক্ষিত থাকলেও, ক্রমান্বয়ে অর্থকরী ফসল হিসেবে এর জনপ্রিয়তা বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে নোয়াখালী, লক্ষ¥ীপুর এবং ভোলা জেলায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের পোল্ডারে ভেতরের জমিতে এবং চরাঞ্চলে সয়াবিন চাষ করা যায় এবং ভালো ফলন দেয় ।
আমাদের দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় সয়া খাদ্য অন্তর্ভুক্ত করে আমাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে পারি ।
লেখক: অধ্যাপক ও সয়াবিন গবেষক, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭১২০৮৫৭৬৭, ই-মেইল : mannanagr@bsmaru.edu.bd